ইমাম ইবন কুদামাহ আল-মাকদিসি মৃত্যু ও পরজীবন বিষয়ক বইয়ে1পরকালে ঘটিতব্য বিভিন্ন ইভেন্ট নিয়ে নিবিড় চিন্তা-ভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন-
“এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা কর, কেননা এগুলো তোমাকে সিরিয়াস হতে সহায়তা করবে। মৃতরা প্রথম শব্দ শুনবে ইসরাফিলের শিঙ্গায় ফুৎকারের সময়। নিজে পুনরুত্থিত হওয়ার এবং শব্দে আশ্চার্যন্বিত হওয়ার ব্যাপারটি কল্পনা কর।
…এরপর দেখ বিচার দিবসে কিভাবে মানুষেরা একত্রিত হবে এবং নগ্ন অবস্থায় দন্ডায়মান হবে- সমতল এক ভূমিতে, যেখানে লুকানোর কোন জায়গা নেই।…এরপর গোলমাল ও মানুষের ভীড়ের ব্যাপারে চিন্তা কর; সূর্য একেবারে মাথার কাছে, মারাত্মক ঘর্মাক্ততা, অন্তরের উদ্বেগ।…ঐ প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে ভাব, যা তোমার প্রভূ- কোন মধ্যস্থতাকারী ছাড়া- সরাসরি জিজ্ঞেস করবে তোমাকে।”
মৃত্যু ও পরকাল ভাবনা প্রকৃত মুসলিমদের চিন্তায় সদা জাগ্রত। মাঝে মাঝে সেই চিন্তা অধিক জীবন্ত হয়ে ওঠে। বিশেষতঃ কষ্ট ও বিপদ কালে- আমরা যখন বেদনা ও অসহায়ত্ব অনুভব করি- তখন মৃত্যু ও পরকালের কথা স্মরণে আসে। কিন্তু এসব কথা ইমাম ইবন আল-যাওজীর স্মরণে আসল আনন্দঘন এক মুহুর্তকে কেন্দ্র করে। ঈদ-এর চেয়ে আনন্দপূর্ণ আর কোন অনুষ্ঠান আছে কি মুসলিমদের! সেই ঈদের দিনের লেন্সে তিনি ফুটিয়ে তুললেন বিচার দিবসের চিত্র। তিনি বলেন2–
আমি ঈদের দিনে মানুষদেরকে দেখলাম এবং তার ও বিচার দিবসের মধ্যে সাদৃশ্য দাড় করালাম। ঘুম থেকে উঠে মানুষেরা (ঈদের সালাতে) সমবেত হয়, ঠিক যেমন মৃতরা কবর থেকে জাগ্রত হয়ে সমাবেশ স্থলে একত্রিত হবে।
কেউ কেউ আকর্ষণীয়রূপে সজ্জিত, বিলাসবহুল বাহনের যাত্রী; কেউ কেউ এ্যাভারেজ; আবার কেউ কেউ তুচ্ছ। বিচার দিবসেও ঘটবে এমনটি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন, “সেদিন দয়াময়ের কাছে পরহেযগারদেরকে অতিথিরূপে সমবেত করব,”3 অর্থাৎ আরোহী রূপে। “এবং অপরাধীদেরকে পিপাসার্ত অবস্থায় জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাব।”4 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের হাশর করা হবে পদাতিক ও আরোহী রূপে এবং তোমাদের চেহারার উপর টেনে-হেঁচড়ে নেওয়া হবে (কতককে)।”5
ঈদের দিনে কতক লোক ধনী দানকারী; এই দুনিয়ার ভাল লোকেরা বিচার দিবসেও ভালোদের মাঝে। কতক লোক গরীব- ভিক্ষা চায়। একইভাবে, বিচার দিবসেও- “আমার উম্মাতের কবীরাগুনাহকারীদের জন্য আমার শাফা’আত রয়েছে।”6 কেউ কেউ এমন আছে যারা কোন কৃপা লাভ করবে না- “অতএব আমাদের কোন সুপারিশকারী নেই। এবং কোন সহৃদয় বন্ধুও নেই।”7
… তারপর তারা ঈদ(গাহ) থেকে উপহার সামগ্রী নিয়ে বাড়ি ফেরে, এবং তাদেরকে বলা হয় হুকুম পালন করার জন্যই এগুলো- “তারাই নৈকট্যশীল।”8 এবং (একইভাবে বিচার দিবসেও) তাদের রায় দেয়া হবে- “এটা তোমাদের প্রতিদান। তোমাদের প্রচেষ্টা স্বীকৃতি লাভ করেছে।”9
তাদের নিচের লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন স্ট্যাটাসের; কেউ কেউ আড়ম্বরপূর্ণ গৃহে প্রত্যাবর্তন করবে- “বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে”10 কেউ কেউ এ্যাভারেজ, এবং কেউ কেউ ফিরবে অনধ্যুষিত গৃহে। “অতএব, হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ, তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।”11
করোনাভাইরাস যখন পুরো পৃথিবীকে স্থবির করে তুলেছে, মানুষের ইচ্ছামাফিক গতিবিধি যখন নিষিদ্ধ, যেকোন নিরাপত্তা ব্যবস্থাই যখন অপূর্ণ- তখন উন্মুক্ত দরজা হিসেবে কেবল আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিনেরটাই বর্তমান আমাদের সম্মুখে। এই দুর্যোগকালে, বিচার দিবসের কিছু চিত্র অনুধাবন করার চেষ্টা করি আমরা-
১. কোভিড-১৯ এর আগমন হঠাৎ করেই। শুরু হল তান্ডব। উপেক্ষা করার কোন সুযোগ রইলনা মানুষের। এক স্তর থেকে পরের স্তর কেবলই কঠিনতর রূপ ধারন করতে লাগল। এমতবস্থায়, অনেকে ইসলামের বিধান অনুযায়ী যথার্থরূপ আচরণ করতে লাগল- এরা সুপথ প্রাপ্ত। খানিক ভোগান্তি হলেও, আল্লাহর কাছে তাদের জন্য রয়েছে পুরষ্কার। কিন্তু পথহারাদের জন্য কেবলই ভীতি ও অনিশ্চয়তা।
বিচার দিবসেরও আগমন ঘটে যাবে হঠাৎ। আকাশ বিদীর্ণ হবে, নক্ষত্রসমূহ ঝরে পড়বে, সমুদ্রকে উত্তাল করে তোলা হবে, পর্বতমালা হবে ধুনিত রঙ্গীন পশমের মত। ধাপে ধাপে চূড়ান্ত ফলাফলের দিকে ধাবিত হবে সবাই। অবশেষে আল্লাহর প্রিয়ভাজনেরা নিশ্চিত শান্তি ও নিরাপত্তার অধিকারী হবে। আর পথভ্রষ্ঠরা প্রাপ্ত হবে অশান্তি ও দুর্ভোগ।
২. মানুষ এখন সর্বাগ্রে নিজ নিরাপত্তার ব্যাপারে চিন্তিত। নিজে যদি কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়, তাহলে অন্যদের কল্যানে সে আর কার্যকর নয়। আর তার নিজের ক্ষতি তো আছেই! তাই সে বাধ্য নিজে আক্রান্ত না হবার চেষ্টায় নিবেদিত হতে। বিচার দিবসেও মানুষ হবে আত্মকেন্দ্রিক। আল্লাহ বলেন, “যেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি আত্ন-সমর্থনে সওয়াল জওয়াব করতে করতে আসবে…”12
৩. কোভিড-১৯ যেখানে বর্তমান, সেখানে যারা উপস্থিত থাকে, তারা সবাই ‘ফোকাসড’- সুনির্দিষ্ট কাজের বাইরে তারা উদাসীন। একইভাবে, বিচার দিবসে মানুষের থাকবেনা এদিক-ওদিক মনোযোগ দেয়ার কৌতুহল।
আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষকে হাশরের মাঠে উঠানো হবে নগ্ন পদ, নগ্ন দেহ ও খাতনাবিহীন অবস্থায়। ‘আয়িশাহ বলেন, আমি তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তখন তাহলে পুরুষ ও নারীগণ একে অপরের দিকে তাকাবে। তিনি বললেন: এরকম ইচ্ছে করার চেয়ে তখনকার অবস্থা হবে অতীব সংকটময়।13
৪. কোভিড-১৯- এ যে আক্রান্ত, সে সবার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। মা-বাবা, স্বামী/স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী- সবাই তার থেকে দূরে। কারোরই তার কাছে আসার সুযোগ নেই। বিচার দিবসেও চরম ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি পর্যন্ত নিকটে ভিড়বে না। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন-
“সেদিন পলায়ন করবে মানুষ তার ভ্রাতার কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে।”14
৫. কোভিড-১৯ থেকে পালানোর কোন পথেরই দেখা মিলছে না। যুদ্ধ বাধলে অন্য দেশে আশ্রয় নেয়া যায়। বিষন্নতা কাটিয়ে উঠতে প্রিয়জনদের কাছে ছুটে যাওয়া যায়। সুরক্ষিত যায়গায় নিরাপদ বোধ করা যায়। বডিগার্ড দ্বারা বেষ্ঠিত হয়ে আক্রমনের হাত থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু কোভিড-১৯ থেকে মুক্তি পাবার ক্ষেত্রে এগুলো সবই অকার্যকর।
বিচার দিবসেও মানুষ কোনও আশ্রয়ই তৈরি করতে পারবে না। পাপাচারীরা তাদের লিডারদেরকে ভূমিকা রাখতে বলবে। মূর্তি উপাসকরা তাদের উপাস্যের সাহায্য চাইবে। কিন্তু কোন ফলই হবে না তাতে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ ব্যতীত কোন শক্তিই সেদিন কোন ক্ষমতার অধিকারী হবেনা।
৬. এত পরিচ্ছন্নতা, এত কর্মকান্ড। তারপরও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না যে, সে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত। যাকে দয়ালু আল্লাহ রক্ষা করবেন, সে-ই কেবল নিরাপদ থাকবে কোভিড-১৯ থেকে। বিচার দিবসের ক্ষেত্রেও, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না তার ফলাফল। সে যথাসাধ্য পূণ্য করে যাবে। কিন্তু চূড়ান্ত মুক্তি নির্ধারিত হবে আল্লাহর ক্ষমা যোগ হয়েই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা জেনে রাখ, তোমাদের কেউ আমলের দ্বারা নাজাত লাভ করতে পারবে না। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনিও নন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমিও নই। তবে আল্লাহ তাআলা যদি তাঁর রহমত ও অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে আবৃত করে নেন।15
করোনাভাইরাস কেবলই একটি ব্যাধি। একটি পরীক্ষা। বিভিন্ন সময়ে এরকম- এমনকি এর চেয়েও মারাত্মক ব্যাধি- মানবতাকে গ্রাস করেছে। মানুষ সেগুলো থেকে মুক্ত হয়ে এসেছে। করোনাভাইরাসও এক সময়- আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিনের ইচ্ছায়- কাবু হবে। মানুষ আবারও স্বাভাভিকতা ফিরে পাবে। অনেক দূর্বলতা কাটিয়ে উঠবে। বস্তুতঃ এ এক ক্ষণস্থায়ী প্যানডেমিক।
তবে বিচার দিবসে আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হওয়াটা এক অতুলনীয় ইভেন্ট। সকল সময়ের সকল মানুষ, অপরিহার্যভাবে, উপস্থিত হবে সেখানে। সকলের পরম সফলতা-ব্যর্থতা নির্ণীত হবে সেখানে। বিচার দিবসের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান তাই আমাদের প্রত্যেকের জন্যই জরুরী। করোনাভাইরাস প্যানডেমিকের মত আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাকে সামনে রেখে আমরা বিচার দিবসের সামান্য কিছু দিকই কেবল অনুধাবন করতে পারি। কিন্তু প্রকৃত সচেতনতার জন্য দরকার মজবুত ঈমান এবং এর সবিস্তার অধ্যয়ন।
ফুটনোটস
The Remembrance of Death and the Afterlife by Imam Ibn Qudamah al-Maqdisi, p. 45-7, 2018, Birmingham: Dar as-Sunnah Publishers
Captured Thoughts (Sayd al-Khatir) by Ibn al-Jawzi, p. 987-9, 2018, Birmingham: Dar as-Sunnah Publishers
আল ক্বুর’আন, মারইয়াম ১৯:৮৫
আল ক্বুর’আন, মারইয়াম ১৯:৮৬
সুনান তিরমিজী, হাদীস নং ৩১৪৩, ইসলামী ফাউন্ডেশন, https://bit.ly/39SQMh8 (Accessed 8/4/20)
সুনান তিরমিজী, হাদীস নং ২৪৩৮, ইসলামী ফাউন্ডেশন, https://bit.ly/2RorwIZ (Accessed 8/4/20)
আল ক্বুর’আন, আশ-শু’আরা ২৬:১০০-১০১
আল ক্বুর’আন, আল-ওয়াকিয়া ৫৬:১১
আল ক্বুর’আন, আল-ইনসান ৭৬:২২
আল ক্বুর’আন, আল-হাক্কাহ ৬৯:২৪
আল ক্বুর’আন, আল-হাশর ৫৯:২
আল ক্বুর’আন, আন-নাহল ১৬:১১১
সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৫২৭, তাওহীদ পাবলিকেশনস, https://bit.ly/39ToH9e (Accessed 8/4/20)
আল ক্বুর’আন, আবাসা ৮০:৩৪-৬
সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৮৫৬, ইসলামী ফাউন্ডেশন, https://bit.ly/2y0iUl0 (Accessed 8/4/20)