আমি যেহেতু সাত মসজিদ রোড দিয়ে প্রতিদিনই যাতায়াত করতাম তাই জায়গাটা খুঁজে পেতে কোন সমস্যাই হলনা। এমনকি আমি আগে থেকেই জানতাম যে, এই বাড়িতেই থাকেন শাহাদাত কাকা- চাকরি করেন। বাড়িতে ঢুকতে আরো কয়েকজনকে দেখলাম। তাদের সবারই কর্মস্থল কাম আবাস এটি। কেউ ড্রাইভার, কেউ বা অন্য কোন পদের কর্মচারী। আমি পরিচয় দিতেই তারা আমার আগমনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তারা আমার আগমনেরই অপেক্ষা করছিলেন।
কাকা ঐ মুহুর্তে বাইরে ছিলেন। হয়ত সন্তানদের জন্য কিছু কিনে আনতে। উনার সহকর্মীরা আমাকে জানালেন, আমাকে কিছুই বলতে হবে না। উনারা অলরেডি কিছু একটা বলে বুঝিয়ে জলদি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হতে উনাকে রাজি করিয়েছেন। আমাকে কেবল উনাকে নিয়ে সোজা গাবতলী গিয়ে সেখান থেকে বাসে করে গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। অল্পক্ষণ পরেই কাকা এলেন। ব্যাগ গোছানোই ছিল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
পদ্মা নদী পার হবার সময় লঞ্চের ছাদে সালাহ আদায় করলাম আমরা। কাকা একজন সহজ-সরল ধার্মিক মানুষ। পদ্মার ঐ পারেও ‘আসরের সালাহ’র ওয়াক্ত হলে তিনি বাস থামানোর অনুরোধ করলেন। আমি খেয়াল করলাম অত্যন্ত আনন্দচিত্তে কাকার এই অনুরোধ রাখলেন বাসের স্টাফরা। আরো খেয়াল করলাম, বাসের সবাই-ই স্বাভাবিকভাবে নিল ব্যাপারটি। আমার কাছে খুবই খুশী লাগল। পরবর্তীতে আমিও একবার একটি আন্তঃনগর বাসে চড়াকালে সালাহ’র জন্য যাত্রা বিরতির অনুরোধ করেছিলাম। সাড়াও পেয়েছিলাম। সেবার এবং এই ‘আসর- দুই বারেই বাসের অন্য আরো অনেকে সালাহ আদায়ের সুযোগটি লুফে নিয়েছিলেন।
সিটে কাকা প্রায় স্বাভাবিকই ছিলেন। শুধু একটু পর পর উনার ছেলে আব্দুল্লাহর ব্যাপারে নানান কিছু বলছিলেন- আব্দুল্লাহ এটা বলে, আব্দুল্লাহ এটা করে। আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন- আব্দুল্লাহর আসলে কি হয়েছে, বল তো ব্যটা? আমি তেমন কিছু না বলে অন্য কথায় চলে যেতাম।
বাসস্ট্যান্ডে আমাদের জন্য মোটর সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন কাকার ভগ্নিপতি। ভগ্নিপতিকে দেখে তিনি একটু অবাকই হলেন। তবে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াই দেখালেন। হয়ত ভাবলেন তার আগমন নিছক কোইনসিডেন্ট। কিন্তু বাড়ি ঢোকার আগেই তিনি আঁচ করতে পারলেন সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে। কাঁদতে কাঁদতে উঠানের ভীড় ভেঙ্গে সামনে এগিয়ে দেখেন জমিনে শুয়ে আছে উনার সন্তান। আব্দুল্লাহ মৃত! আমাদের বাড়ির পাশের খালে সকাল বেলায়ই ডুবে মরেছে সে। কাকার যে কি কান্না!
ক’দিন আগে আমার স্ত্রী আমাদের এক আত্মীয়ার সন্তানের ডুবে মরার খবর দিল আমায়। খবরটি আমার অন্তরে একটি বিশেষ দাগ কাটলো। কেননা ঐ আপা প্রায় দেড়যুগ ধরে ছিলেন সন্তানহীনা। অতঃপর উনার একে একে দু’টি সন্তান হয়। তাদেরই একজন কিনা মারা গেল পানিতে পড়ে! আমার ভাগ্নীর ক্লাসের ফার্স্ট বয় এইচ এস সি পরীক্ষার অল্প কিছু দিন আগে মৃত্যবরন করে পানিতে। আমার মামা একজনের জীবনাবসান হয় পানিতে।
পানিতে ডুবে মরার এত এত যে ঘটনা, একি নিছক প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা? নিঃসন্দেহে না! এও আধুনিক ব্যবস্থার পক্ষে মানবজীবনের অবমূল্যায়নের অত্যাবশ্যকীয় পরিনাম। এই ব্যবস্থায় মানবজীবন কেবলই এক পণ্য। তা ততটুকুই পাত্তা পাবে যতটুকু তাকে অর্থ উৎপাদনে ব্যবহার করা যাবে।
খোঁজ নিলে জানতে পারবেন পৃথিবীতে হাজার হাজার দুর্লভ রোগ আছে যার কোন চিকিৎসা নেই। কারন এই নয় যে, তা দুঃসাধ্য। বরং কারন এই যে, তা উদ্ভাবন করলে কিইবা এমন ব্যবসা হবে! কিন্তু যদি মানব জীবনের মর্যাদা যথার্থভাবে সমুন্নত থাকত, তাহলে একজনের জন্যও হলেও পূর্ণ সিরিয়াসভাবে চিকিৎসা উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা হতনা কি?
কোভিড প্যানডেমিক আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে কত উদাসীন ও অপ্রস্তুত বৈশ্বিক জীবনরক্ষা খাত। কিন্তু ধ্বংসের ব্যাপারে দেখুন! ধ্বংস করা লাগবে কি লাগবে না, করা হবে কি হবে না- তা জানার আগেই সবাই ধ্বংস সামগ্রী নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুত।
আধুনিক ব্যবস্থায় এত জ্ঞান, এত অর্থ। যদি আসলেই মানব জীবনের মূল্য থাকত তবে অবশ্যই পানিতে ডুবে মরা রোধে অনেক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যেত। হোক তা সচেতনতামূলক, হোক তা অন্য কোন উদ্ভাবনী কায়দায়। আরো অধিক আয়োজন থাকত সু-শিক্ষায়, মানুষের জীবনমান রক্ষায়, নিরাপত্তায়, এবং আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখায়। তাহলে ভূমধ্যসাগরের পানিতে ভাসত না অভিবাসীর লাশ। শীতলক্ষ্যায় ভাসত না বুয়েট ছাত্রের লাশ।